শনিবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২৫, ০৩:৫৯ অপরাহ্ন
Reading Time: 4 minutes
রণেশ মৈত্র:
সাংবাদিক হিসেবে এ যুগে প্রখ্যাত হলেও, সত্য কথা বলতে কি, ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে আমি চিনি না। বিষয়টি গৌরবের না হলেও সত্য। কারণ ত্রিবিধ। এক. আমার আজীবনের কর্মক্ষেত্র হলো পাবনা; দুই. কখনও কখনও অতীতে ঢাকা গেলেও (বছরে তিন চারবার) তা যেতাম সাধারণত: স্বাস্থ্যগত কারণে ও রাজনৈতিক কর্মসূচী উপলক্ষ্যে; এবং তিন. ২০২০ এর মার্চের ২০ তারিখে সেই যে ঢাকা থেকে ফিরেছি ডাক্তার দেখিয়ে এবং টি.ভি’র কয়েকটি চ্যানেলে টক-শো তে অংশ নিয়ে করোনার কল্যাণে তখন থেকেই গৃহবন্দী হয়ে আছি। আরও একটি কারণ এবং হয়তো বা সেটি অন্যতম প্রধান কারণ, করোনার ভয়ে স্থানীয় প্রেসক্লাব বা পাবলিক লাইব্রেরীতে যাওয়া পূরোপূরি বন্ধ থাকায় “প্রথম আলো” দেখার বা পড়ার সুযোগ ঘটে ওঠে না। তাই রোজিনার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলি পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত।
কিন্তু গত ১৭ মে থেকে মনে হচ্ছে রোজিনা ইসলাম কতই না চেনা-কতই না আপনজন। আমার সাংবাদিকতা পেশার এখন ৬৮ বছর চলছে রোজিনার হয়তো তার অর্ধেকও নয়। তবু রোজিনার কাছ থেকে অনুসন্ধানী সাংবাদিকাতার, সত্য প্রকাশের বিপদ সম্পর্কে নতুন করে শিক্ষা এতদিন ভাবি নি-এমন কোন শিক্ষা এই ৯০ ধরি ধরি বয়সে নেওয়ার দুর্ভাগ্য হবে-তা-ও আবার মহান মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে।
কী ঘটেছে রোজিনার? তিনি গিয়েছিলেন সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের কক্ষে। সচিব দিলেন না। রোজিনা ঢুকতে ইত:স্তত বোধ করলেন সচিবের ঘরে তাঁর অনুপস্থিতিতে ঢুকবেন কি ঢুকবেন না। তখন ডিউটিরত পুলিশ কনষ্টেবল তাঁকে ঘরে গিয়ে বসতে বললে রোজিনা বললেন, সচিব অনুপস্থিত-এমতাবস্থায় ঢোকা ঠিক হবে? কনষ্টেবল আস্বাস দিয়ে বললেন, অসুবিধা নেই-বসুন। তখন বসলেন রোজিনা টেবিলে থাকা দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকাটি নিয়ে চোখ বুলাতে লাগলেন। কিন্তু তাঁকে ঘিরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা যে আগে থেকেই ষড়যন্ত্রের ফাঁদ তৈরী করে রেখেছে-রোজিনা তা বুঝতে পারেন নি।
এক পর্য্যায়ে ছুটে এলেন ঐ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জেবুন্নেসা আহম্মেদ। তিনি এসেই রোজিনাকে মারধর সুরু করলেন-তাঁর গলা টিপে ধরলেন। সরাসরি জেবুন্নেসা অভিযোগ করলেন, আপনি গোপনে সরকাথি নথি চুরি করেছেন। রোজিনা অস্বীকার করলে তিনি বলেন, মোবাইলে গোপণীয় তথ্যের ছবি তুলেছেন-বলেই কেড়ে নেন রোজিনারহাত থেকে তাঁর মোবাইল। গলা টিপে ধরে থাকলেন দীর্ঘ সময়। সকল নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে দীর্ঘ ৫ ঘন্টা রোজিনাকে সচিবালয়ে আটকে রাখা হয়। জেবুন্নেসার সাথে ডিউটিরত পুরুষ-নারী কনস্টেবল ও রোজিনাকে আঘাত করেন। রোজিনা বমি করে ফেলেন কিন্তু তাঁকে হাসপাতালে পাঠানো বা ডাক্তার ডেকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলো না। দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টা পর সংশ্লিষ্ট থানায় তাঁকে হস্তান্তর করা হয় রোজিনার বিরুদ্ধে সরকারি গোপন তথ্য চুরির দায়ে। তখন রাত সাড়ে আটটা। তিন ঘন্টা থানায় আটকে রেখে মামলা রেকর্ড করা হয়।
খবর পেয়ে ছুটে আসেন সচিবালয়ে কর্মরত অপরাপর সাংবাদিকেরা। তাঁরা বার বার অনুরোধ জানান অসুস্থ হয়ে পড়া রোজিনার চিকিৎসা প্রয়োজন-দ্রæত তাঁকে হাসপাতালে পাঠানো হোক বা ডাক্তার ডেকে এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক। না, পুলিশ সাংবাদিকদের কথায় কর্ণপাত করলেন না। তিন ঘন্টা বসিয়ে রাখলেন রোজিনাকে। পরদিন মঙ্গলবার রোজিনাকে আদালতে নেওয়া হলো। পুলিশ আবেদন জানালো পাঁচ দিনের রিম্যান্ড রোজিনাকে পুলিশের হেফাজতে হস্তান্তর করা হোক। এ আবেদন শুনানী করে আদলত তা নামঞ্জুর করলেন। রোজিনার পক্ষে জামিনের আবেদনও দেওয়া হয়েছিল তা শুনানীর জন্য বৃহস্পতিবার দিন ধার্য্য করেন আদালত।
জানা গেল রোজিনার বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেটস এ্যাক্ট এবং আরও দুটি পেনাল কোডের ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে অফিসিয়াল সিক্রেট্স্ অ্যাক্ট ১৮৯৯ সালে বৃটিশ সাম্ররাজ্যবাদ বৃটিশ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনকারীরা যাতে সরকারি তথ্য বা নথি না পায় তার জন্যে। ১৯২৩ সালে ডিজিট্যাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারাও ঐ আইনের সাথে যুক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশে বৃটিশ ঊপনিবেশিক আমলের অফিসিয়াল সিক্রেট্স্ অ্যাক্টে এই প্রথমবারের মত মামলা দায়ের করা হলো একজন প্রথিত যশ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। সচিবালয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় নথি ‘চুরির চেষ্টার(চুক্তী নয়) অভিযোগে দীর্ঘ সময় আটকে রেখে হেনস্তা করার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে ১৯২৩ সালের অফিসিয়াল কিক্রেট্স্ অ্যাক্ট এবং পেনাল কোডের অপর দুটি ধারায় মামলা দায়ের করেন।
সর্বত্র এর পর থেকে আলোচনা চলছে বহু বছর ধরে প্রায় পরিত্যক্ত এই আইনটি, প্রশ্ন উঠেছে কী আছে এ আইনে? এই আইনে কেনই বা মামলা দেওয়া হলো একজন পেশাদার সাহসী সাংবাদিকের বিরুদ্ধে? কিংবা এই আইন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায় কিনা এ নিয়ে সর্বত্র আলোচনার ঝড় উঠেছে।
আইন ও গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৯২৩ সালের এই আইনটি ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইন এবং ২০১১ সালে প্রণীত জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইনের পরিপন্থী। তাঁরা বলেন, প্রেক্ষাপট বিচারে বৃটিশ আমলের এই শতবর্ষী আইনটি এখন একেবারেই অপ্রসাঙ্গিক এবং এটি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা সিঃসন্দেহে আইনটির অপপ্রয়োগ।
১৮৯৯ সালে বৃটিশ আমলে তদানীন্তন ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জন দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমবার ইন্ডিয়ান অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট প্রণয়ন করেন। মূল উদ্দেশ্য ছিল, সে সময়কার বৃটিশ-বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনকারীরা যেন সরকারি নথি বাতথ্য না পায়, তা নিশ্চিত করা। অর্থাৎ বৃটিশদের অধীন চাকুরীরত ভারতীয় কর্মকর্তা যেন স্বদেশীদের কাছে গোপনে তথ্য না দিতে পারেন সেজন্য সামন্তযুগের “গুপ্তচর বৃত্তি” এখানে আইনের ধারা হিসেবে সংযুক্ত করা হয়। ১৯০৪ সালে এই আইনটি সংশোধন করে আরও কঠোর করা হয়। পরবর্তী কালে ভারতের পরবর্তী ভাইসরয় ১৯২১ সালে নতুন করে আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেন। তখন আইনটির নতুন নাম হয় অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯২৩। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের ৩০ জুন প্রণীত ‘দ্য বাংলাদেশ লজ (রিভিশন এÐ ডিক্লারেশন) অ্যাক্ট এর দ্বিতীয় তফশীলে দুটি শব্দ পরিবর্তন করে সরকারি গোপনীয়তা সংক্রান্ত ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টটি আত্তীকরণ করা হয়।
সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেট্স্ অ্যাক্ট প্রশাসন মামলা দায়েরের পর দিল্লীর একটি হাই কোর্ট বেঞ্চ এই আইন সাংবাদিক বা সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যাবে না বলে রায় দেন। ইংল্যাÐে ১৯৮০ সালে সামগ্রিম আইন সংস্কার হলে অফিসিয়াল সিক্রেট্স্ অ্যাক্ট বাতিল হয়ে যায়।
বাংলাদেশে বর্তমানে চালু থাকা ১৯২৩ সালের অফিসিয়াল সিক্রেট্স্ অ্যাক্টের ৩ ও ৫ নং ধারায় রাষ্ট্রীয় গোপনীয় নথি নিজের দখলে নিয়ে অপরপক্ষকে পাচারের বিষয়টি প্রমাণ হলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদÐ বা ১৪ বছরের জেল এবং সর্বনিম্ন সাজা দুই বছর কারাদন্ড রাখা হয়।
বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিষ্টার জ্যেতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ২০১১ সালে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আনি পাস হয়েছে। এই আইনে বলা হয়েছে জনস্বার্থে জরুরী মনে হলে গোপনীয় হলেও সে তথ্য প্রকাশ করা যাবে। এমন কি যদি তথ্যের সমর্থনে ডকুমেন্ট না থাকে কিন্তু তথ্য সত্য বলে বিশ্বাস করার দৃঢ় ভিত্তি আছে, তা হলেও তথ্য প্রকাশ করা যাবে এবং তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষা দিতে হবে। এমন কি, এ আইনে জনস্বার্থে তথ্য প্রকাশকারীকে পুরস্কৃত করার বিধানও আছে। রোজিনা ইসলাম জনস্বার্থে তথ্য প্রকাশ করেছেন কিংবা প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। অতএবং তাঁকে আইন অনুযায়ী পুরস্কৃত করার কথা। অথচ সরকারি কর্মকর্তারা তাঁকে আটকে রেখে হেনস্তা করেছেন। এ কারণে এ আইনের ৯ ধারা অনুযায়ী এ ঘটনা ঘটিয়ে সরকারি কর্মকর্তারা ফৌজদারী অপরাধ করেছেন বলেও প্রতীয়মান হয়।
তিনি আরও বলেন, অফিসিয়াল সিক্রেট্স্ অ্যাক্ট ঐপনিবেশিক যুগে ভারতের স্বদেশী আন্দোলন দমন মাথায় রেখে তখনকার ঐপনিবেশিক শাসকেরা করেছিলেন। এ আইন স্বাধীন দেশে থাকাটাই অগ্রহণযোগ্য অথচ সেটার প্রয়োগ হচ্ছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে। এটা খুবই লজ্জার।
বস্তুত: অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাই গণতান্ত্রিক পৃথিবীর সকল দেশে গুরুত্বপূর্ণ এবং দায়িত্বপূর্ণ ও জসস্বার্থে নিবেদিত সাংবাদিকতা হিসেবে স্বীকৃত। রোজিনা সাংবাদিকতার শুরু থেকেই সেই পথটাকেই বেছে নিয়েছেন বলে তিনি দেশ বাসীর কাছে অভিনন্দন যোগ্য। সচিবালয়ে সংঘটিত রোজিনার হেনস্তা ও নির্য্যাতন এবং শেষ পর্য্যন্ত পরাধীন যুগের আেিন তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও গ্রেফতার নিশ্চিতভাবেই অনুসন্ধানী সহ সমগ্র সাংবাদিকতা তথা গণতন্ত্রের টুপি চিপে ধরার সামিল।
মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ জয়ন্তীর এই বছরে এই জাতীয় অপ্রত্যাশিত ঘটনায় সাফাই গাইলেও স্বাস্থ্যকর্মী। নানা মাধ্যমে প্রকাশিত হেয়ছে তাঁর মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জেবুন্নেসার বিপুল বিত্ত বৈভবের ফিরিস্তি। দ্রæত এগুলির সুষ্ঠু তদন্ত এবং রোজনাকে হত্যার প্রচেস্টার অভিযোগে তাঁর ও সংশ্লিষ্ট বিরুদ্ধে জেবুন্নেসা) মামলা দায়ের করে সত্বর তাঁদেরকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো উচিত। তথাকথিত বিভাগীয় শাস্তি এক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রীকেও অবিলম্বে পদচ্যুত করা প্রয়োজন।
সর্বাগ্রে প্রয়োজন, মিথ্যে অভিযোগে দায়েরকৃত রোজিনার বিরুদ্ধে মামলা অবিলম্বে নিঃশর্তভাবে প্রত্যাহার করা এবং অফিসয়িাল সিক্রেট্স্ অ্যাক্ট ও ডিজিট্যাল নিরাপত্তা আইন বাতিল।
লেখক
রণেশ মৈত্র
একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক